
একজন চাকরি হারানো কর্মীর জীবন
১১-বছরের বেশি হয়ে গেলো এনজিওতে কাজ করি। ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং লাখো মানুষের সাথে আমারও চাকরি চলে যাওয়ায় একেবারে কাজশূন্য হয়ে যাওয়াটা মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভাবছি লেখালেখি করে এটার একটা ফয়সালা করা সম্ভব। তাই গতকাল থেকে লেখা শুরু করলাম, কতোদিন এই লেখার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবো নিশ্চিত নই।
চাকরির প্রথম জীবন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ এর গণ্ডী পার হবার আগেই ২০১১ সালে হুট করে ডেকে বসে গ্রামীনফোন, বেসিস, আর ক্রিয়েটো নামের একটা ক্রিয়েটিভ এজেন্সি। এর মধ্যে গ্রামীনফোনের ইন্টারভিউ এর দিন টার্ম ফাইনাল ছিলো, যাইনি, ক্রিয়েটো এবং বেসিসের ইন্টারভিউ পরপর দুইদিনে পড়ে। ক্রিয়েটোতে ইন্টারভিউ দেবার পরে কনফিডেন্স ছিলো হয়ে যাবে, এবং বিকালের মধ্যেই জানান দিলো যে আমাকে অফার করতে চায়, মনের শান্তিতে পরদিন বেসিসে ইন্টারভিউ দিলাম। কয়েক বন্ধু মিলে বিভিন্ন অফিসের ইন্টারভিউ দিয়ে একই সাথে বাসে ফেরার পথে বেসিস থেকেও আমাকে ফোন করে জানানো হলো আমি বেসিসে টিকে গেছি।
বরাবরই ক্রিয়েটিভ জায়গাতে আমি নিজেকে পারফেশনিস্ট না হতে পারলে প্রফেশনাল কাজ করার সাহস পাইনি, আর আইটির উপরে একটা আগ্রহ ছিলো, কোনও চিন্তাভাবনা না করেই বেসিসে যোগ দিলাম। তখন আমার বন্ধুদের কেউ কেউ বিসিএস, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে, যারা প্রাইভেটে জব খুঁজতে ইচ্ছুক, সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে, আমি কাউকে কোনও রিকোয়েস্ট না করেই শুধুমাত্র অ্যাপ্লিকেশন সাবমিশনের মাধ্যমে ইন্টারভিউ দিয়ে ওই যে চাকরি পেলাম, এর পর থেকে আমার নন-প্রফিটের যাত্রা শুরু।
নেদারল্যান্ডস এমব্যাসি এর ফান্ডিং এ তখন ফ্রিল্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রির ডেভেলপমেন্ট, ই-গভরন্যান্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং একটা বড়ো ইভেন্ট বলতে ই-এশিয়া (এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে কনফারেন্স হয়, এছাড়াও বেসিস সফট এক্সপো এর কথা তো অনেকেই জানে) এর কাজ তুললাম। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়মিত যেতে হয়েছে কিছুদিন এই ইভেন্টের জন্য, সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যাকগে, বেশি বলতে গেলে পলিটিক্যাল অনেক কিছু চলে আসবে, ও পথে আর না বাড়াই।
এরপরে হলো টা কি, আমার ইন্টার্নশিপ/থিসিস রেজিস্ট্রেশনে কোনও কারণে ফ্যাকাল্টি আমাকে থিসিস রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দেয়, কোনওভাবেই কাগজপত্রের ভার আর ফ্যাকাল্টিদের ভয়ে আর ওটা ইন্টার্নশিপে আনার ব্যবস্থা করতে পারিনি, চাকরি বাদ দিয়ে ডিগ্রি কমপ্লিট করতে চাকরির ৭-মাসের মধ্যেই খুলনা ফিরে আসতে হলো।
২০১২ সালে রেজাল্ট বের হলো, ওই বছর জব খুঁজতে খুঁজতেই চলে গেছে, বড়ো ভাই-টাই বন্ধুদের পরামর্শে দুই-একবার যে বলিনি তা না, কিন্তু ওই যে বলার মধ্যে একটা আগ্রহ থাকে, ওই আগ্রহ বড়ো ভাইরা দেখতে পাননি বোধহয়, তাই ওভাবে চাকরি হয়ওনি। খুব একটা ডেস্পারেট হবার আগেই ২০১৩ সালে সুশীলনে একটা চাকরি হলো, সেখানে রিসার্চ, ডকুমেন্টেশন, মনিটরিং ইত্যাদির কাজ, পড়াশুনার সাথে কোনভাবেই মিলে না, শেষ-অব্দি বুদ্ধি করে রেগুলার কাজের পাশাপাশি প্রজেক্টে কৃষকদের ভ্যালু চেইনের উপরে কিছু অতিরিক্ত বুদ্ধি দেওয়া শুরু করলাম। কাজটা ছিলো ডব্লিউএফপি আর ইউনিসেফ এর যৌথ অনুদানে এসডিজি এর প্রোগ্রাম।
৬-মাসের মধ্যে প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলো, আসলে শেষের দিকেই ঢুকছিলাম, আবার বেকার, এবার আর ইউনিভার্সিটিতে ফেরার সুযোগ নেই। ভাবলাম যতদিন আরেকটা জব না পাই, ফ্রিল্যান্সিং করি, আপওয়ার্কে লোগান গ্যাটিস ডিজাইন নামে একটা কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজও পেয়ে গেলাম, তখন আড়াই ডলার দিতো ঘণ্টায়, ক্রিয়েটো বাদ দিয়ে বেসিসে জয়েন করছিলাম, কিন্তু সেই ক্রিয়েটিভ টিমের কাজেই আবার লেগে গেলাম।
যখন থেকে টানা চাকরি করছি
এর মধ্যে অনেক চাকরিতে অ্যাপ্লাই করছি, কেউ ডাকেনি, মনের মধ্যে একটু দুরু দুরু লাগছিলো যে আসলেই কি কেউ বলে না দিলে চাকরিতে ডাকে না, সেই ভয়টা মনের মধ্যে বসে যাওয়ার আগেই ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পজিশনে ইন্টারভিউ দেবার ডাক পেলাম, আরও দুই-তিনটা নাম মনে নেই এরকম প্রতিষ্ঠানেও ডেকেছে। কোনটাতেই হয়নি।
ওই বেসিস আর সুশীলনের অভিজ্ঞতাই আবার কাজে লাগলো, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জয়েন করলাম জাগ্রত যুব সংঘ (জেজেএস) এ, প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে। তখন ফিল্ডে অনেক বেশি মুভ করছি কাজের বিষয়ে আরও অনেক বেশি সচেতন হয়েছি, আর সরাসরি মার্কেট সিস্টেমস আর ভ্যালু চেইন নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকায় নিয়মিত বসতবাড়ির বাগানগুলো কিভাবে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট উপায়ে করা যায়, এগুলোর কাজ করি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর ফান্ডিং এ কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের টেকনিক্যাল সাপোর্টে। আমার রিপোর্টিং আর প্রেজেন্টেশনের কাজ ভালো দেখে আমার টিম ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটি মেজার করতে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনালের একটা প্রজেক্টেও প্রজেক্ট ফোকাল করে দিলেন, ১২ জনের টিম চালাতাম, অ্যাগ্রি ভ্যালু চেইনের প্রজেক্ট ওইটাও।
আমার একটা দারুন অভিজ্ঞতা হয়েছে জেজেএস-এ, সেখানে প্ল্যানিং, কোঅর্ডিনেশন, রিপোর্টিং, এমনকি ডিজিটাল এবং ডিজাইনের কাজও আমি দেখতাম, ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর দিয়ে নিজেই প্রোগ্রামের কনটেন্ট, ব্যানার ইত্যাদি বানাতাম, একাই একশো কাজ টাইপের শো-অফ করতেও ভালো লাগতো। অনেকগুলো প্রপোজালের কাজ করছি, এমনকি একটা ডিরেক্ট ইউরোপিয়ান কমিশনের কলে তো কনসেপ্ট নোট সাবমিশন করে প্রপোজালের জন্যেও ডেকে বসলো, ওইটা অবশ্য টিম এফোর্ট ছিলো, একা প্রপোজাল লিখছি এটা বলা যাবে না, কিন্তু আইডিয়ার কাজে আমি ছিলাম।
প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন নামের একটা প্রতিষ্ঠান ওই কলে অ্যাপ্লাই করে কনসেপ্ট পাশ হয়নি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সেখানেই আমাকে নিয়ে নিলো ফরিদপুর পৌরসভার জন্য পিপিপি বেজড স্যানিটেশন বিজনেস মডেল দাঁড়া করানোর কাজে। আমার পুরো ক্যারিয়ারে আমার বলা চলে বেসিক যদি দাঁড়া হয়ে থাকে কোনও জায়গা থেকে, সেটা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন। রাফিউল ভাইয়ের সাথে আমি একটু এদিক ওদিক করে আরও ভালো করে ইমপ্লিমেন্ট করলাম, ওই বিজনেস মডেল ডিপিএইচই থেকে শুরু করে বিভিন্ন লোকজন দেখতে আসে, অন্যরা সেটা রেপ্লিকেট করে, এমনকি ইন্ডিয়াতে দুইটা পৌরসভার টোটাল স্যানিটেশন বিজনেস মডেল পর্যন্ত করে দিয়ে আসছি।
দুই বছর সফলভাবে কাজ শেষ করে টেকনিক্যাল টিমগুলোর অ্যানালিস্ট হিসেবে ঢাকায় গেলাম, পরিচিত মানুষের সংখ্যাও বাড়লো, নিজেরও মনে হলো ক্যারিয়ারে আরও আগে যাওয়া প্রয়োজন। ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারি তে ব্র্যাক থেকে এইচসিএমপি (রোহিঙ্গা প্রজেক্ট) এর ওয়াশ এর নলেজ ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিষ্ট হিসেবে নিয়োগ পেলাম।
কক্সবাজারে খুব কষ্টের কাজ, সেখানেও আমাদের ওয়েল উইশার তৈরি হয়েছে, কিন্তু ব্র্যাকের থেকে আমার ক্যাপাসিটি বাড়লো একেবারে জিওমেট্রিক লেভেলে, টিম ম্যানেজমেন্ট এবং কমিউনিকেশনে অনেক চাপ বাড়লো, কিন্তু কোনও একটা কারণে তখন ফান্ডিং এর একটা সংকট তৈরি হলো, এবং এর মধ্যেই ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে ডব্লিউএফপি এবং এসএনভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন থেকে ডাক পেলাম, স্বভাবতঃই এসএনভি খুলনাতে পোস্টিং অফার করায় ডব্লিউএফপির কক্সবাজারের অফার রিজেক্ট করে দিয়ে চলে আসলাম নিজের শহরে।
এসএনভি একটা দারুন প্রতিষ্ঠান, সুন্দর কালচার, কিন্তু প্রজেক্ট আবার শেষের দিকে ২০২০-২১ সালেই। যদিও হয়তো থেকে গেলে অন্য প্রজেক্টে মুভ করার সুযোগ ছিলো, আমি ঢাকার নেটওয়ার্কিং অপরচুনিটি মিস করছিলাম, ভাবছিলাম খুলনায় যদি না থাকি, তাহলে আমার নেটওয়ার্ক বাড়ানোর জন্য ঢাকা বেটার জায়গা। সেই সুবাদে ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন ফর দ্যা আরবান পুওর (উসাপ) এ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জয়েন করি। এখানে এসে আমার বাচ্চা হলো, প্রথম সন্তান, আর উসাপ এর একটা ট্রু ইন্টারন্যাশনাল ফ্লেভার আছে, সাউথ এশিয়ার বাইরে পাড়ি দিয়েছি লন্ডন, ঘুরে এসেছি ইস্তানবুল, আর আমার বিজনেস মডেলগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরের বাইরেও আফ্রিকান কিছু শহরেও কাজে লাগলো।
আড়াই বছর উসাপে কাজ করার পরে আমি আমার জীবনে প্রথম ইউএসএআইডি ফান্ডিং এ কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে কেয়ার বাংলাদেশের সাথে, কমিউনিটি নিউট্রিশন অ্যান্ড হেলথ অ্যাক্টিভিটিতে। প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, উসাপ এই দুইটা ব্রিটিশ অর্গানাইজেশন আমাকে যে ফ্যামিলি ফিলিংস দিয়েছে (বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো খারাপ না, তবে এই দুই জায়গায় আমার টিমগুলো অনেক ভালো ছিলো), তার সব দিক দিয়েই ছাড়িয়ে গেছে কেয়ার এর সাথের অভিজ্ঞতা। শুধুমাত্র নিজের টিমেই না, পুরো প্রতিষ্ঠানেই একটা অন্যরকম ইনক্লুসিভ আচরণ আছে যেটা সহসা সব প্রতিষ্ঠানে আপনি পাবেন না।
বিগত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এ কেয়ারের সাথে শেষ কর্মদিবস ছিলো আমার, ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আমার প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ায় এখন বেকার রোমান্টিসিজম থেকেই হয়তো এতো বিশাল বিশাল পোস্ট লিখছি। গত পোস্টটা ছিলো কেয়ারে ছেড়ে আসা কিছু সুপারগুড বন্ধুপ্রতিম কলিগদের প্রতি ট্রিবিউট। এই পোস্টটা বলা চলে আমাকে নিয়োগ দিয়েছে এমন সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি ট্রিবিউট।
শেষ কথা
কোথায় কি কাজ করেছি এগুলো বললে অনেক লম্বা হয়ে যাবে, এটাই হয়তো কতোজন পড়বে আমি জানি না, তবে আমি সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি, আমার সুপারভাইজদের প্রতি এবং আমার কলিগদের প্রতি কৃতজ্ঞ, তারা আমার উপরে বিশ্বাস রেখেছেন, আমার অনেক অপকর্ম সহ্য করেছেন, আমার অনেক আচরণ তাদের ভালো লেগেছে কি না জানি না, তবে আমি জানি তারা সবাই নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবার মতো মহান মানুষ, নাহলে আমার মতো ক্ষুদ্র সক্ষমতার একজন কর্মীকে এতোদূর টেনে উঠানোর মতো তেমন কিছুই আমার আছে বলে আমার ধারণাতে নেই।