
ম্যাকবুক চালাতে কেমন লাগে?
মানুষের কতরকম শখ থাকে, কেউ কিনতে চায় আইফোন, কেউ হয়তো আর্টিস্ট হতে চায়; এরকম আমারও একটা শখ ছিলো একটা দামী গেজেট আমার থাকুক। অল্প বয়সে বাবার সামর্থ্যের মধ্যে কেনার সক্ষমতা হয়নি কখনও, নিজের কম-দামী বাটন ফোন ব্যবহার করে দুনিয়া জয় করা আমার অন্যের দামী সনি ওয়্যাকম্যান ফোন বা অ্যাপলের ল্যাপটপ দেখতে নিজের মনেও শখ হতো, ইশ, আমিও যদি একটা দামী গ্যাজেট ব্যবহার করতাম।
চাকরিজীবনে ১০-বছর অতিবাহিত হবার পরে ক্রেডিট কার্ডের ইএমআই অফারে কিনে ফেলেছিলাম ম্যাকবুক প্রো এম১ সিরিজের ল্যাপটপ। ততোদিনে আমি আর সেই ছাত্রবয়স ধারণ করিনি, কিন্তু সেই অনুভূতি কখনও যায়নি।
গ্যাজেট হলে ফোন না কিনে ল্যাপটপ কেনো?
আমি একজন পুরোদমে অফিস ওয়ার্কার। বেশিরভাগ অফিসে আপনাকে যে ল্যাপটপ দেবে, সেসব দিয়ে আপনার ব্যক্তিগত কাজ খুব একটা কোনোরকম চালিয়ে নেওয়া গেলেও ক্রিয়েটিভ কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকবে। আমার ফোনে তেমন একটা আগ্রহ নেই, আবার পিসির ক্ষেত্রেও আমি ডেস্কটপ পছন্দ করি।
এদিকে ল্যাপটপ না হলে আজকালকার দিনে মোবিলিটির এই সুবিধা পাওয়া যায় না, তাই ডেস্কটপ লেভেলের পারফরম্যান্স পেতে হলে ল্যাপটপে অনেক হাই-এন্ড পেরিফেরালস (বা পার্টস বলতে পারেন) লাগে। ক্রিয়েটিভ কাজ করতে গেলে উইন্ডোজ এর ল্যাপটপগুলোর গ্রাফিক্স কার্ড সহ অন্যান্য পার্টসের দাম মিলে এতো বেশি দাম আসে, এতে করে তুলনা করলে ম্যাকবুকের দাম কম আসে।
দেখেন, আমার কিন্তু ম্যাকবুকই কিনতে হবে এমন ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু আমার কাছে আমার কাজের জন্য তুলনামূলক ম্যাকবুকের দাম অন্যান্য অনেক উইন্ডোজ ল্যাপটপের থেকেও কম। আমার শখ টুকটাক ডিজাইনের কাজ করা, একটু আধটু ভিডিও এডিটিং করা, আবার ক্যারিয়ার অল্টারনেটিভ হিসেবে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট করা যায় কি না এসবের জন্যেও একটা ভালো ল্যাপটপ প্রয়োজন ছিলো।
ইউটিউব থেকে যতো বেঞ্চমার্কিং (পারফম্যান্স তুলনা করার পরীক্ষা) ভিডিও দেখলাম, অনেক দামী দামী উইন্ডোজ ল্যাপটপের থেকেও ম্যাকবুক এম১ প্রসেসরের সক্ষমতা অনেক বেশি সবাই বলেছে। আবার দামও আমার চাহিদা অনুযায়ী হার্ডওয়্যারের তুলনায় কম, এটাই মূলতঃ আজীবন উইন্ডোজ এনভায়রনমেন্টে কাজ করে আসা আমার জন্য একটা সুযোগ ছিলো এই ল্যাপটপটা কেনার।
তাহলে গ্রাফিক্সের কাজ ম্যাকবুকে কেমন?
জটিল ভাবে না বলি, কখনও একটা ডিজাইন করতে দিয়ে সেটা সেভ করা বা এক্সপোর্ট করতে কেমন সময় লাগে খেয়াল করেছেন? অথবা কোন ভিডিও এডিট করে রেন্ডার করতে দিয়েছেন? আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ৩ লাখ টাকা বাজেটের একটা উইন্ডোজ ল্যাপটপে এই ধরণের কাজ এক্সপোর্ট করতে যে সময় লাগতো, তার তিন ভাগের এক ভাগ সময়ে এই দেড় লাখ টাকার ল্যাপটপ একই কাজ করতে পারে।
তাহলে বুঝেন, পৃথিবীজুড়ে ম্যাকবুকের সুনাম কেনো এতো বেশি। ডিজাইনার বা ডেভেলপারদের টপ চয়েস থাকে ম্যাকবুক।
আমি অ্যাফিনিটি স্যুইট ইউজ করি (অ্যাডবি এর মতো অন্য আরেকটা কোম্পানি), এবং আমার দৈনন্দিন যে ডিজাইনের চাহিদা থাকে, তা পূরণ করতে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দিতে আমার এই ল্যাপটপের জুড়ি নেই। এই সময়ের অভাবের যুগে এক মিনিট বাঁচানোই যেখানে অনেক, সেখানে কয়েক মিনিট, এমনকি ঘণ্টা বাঁচিয়ে দেয় আমার এই ল্যাপটপ।
আচ্ছা, তাহলে আর কি কি ম্যাকবুকে ভালো?
ম্যাকবুকে আপনার ডিভাইসে দাম যদিও কম খরচ হচ্ছে, আপনি কিন্তু ম্যাকবুকে কোন ক্র্যাকড সফটওয়্যার ব্যবহার করলে সেটা ভালোভাবে কাজ করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই আপনাকে অরিজিনাল সফটওয়্যার পেইড হোক বা ফ্রি ব্যবহার করার অভ্যাস করতে হবে। সাধারণতঃ অফিস ওয়ার্কারদের জন্য যে ধরণের সফটওয়্যার লাগে, বেশিরভাগই পেইড, তাই এই জায়গাটাতে অসুবিধা মনে হলেও শুধুমাত্র এই কারণেই ম্যাকবুকের নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক কম।
আর পেইড সফটওয়্যার যতো ব্যবহার করবেন, অপ্রয়োজনে সফটওয়্যার ইন্সটল করা থেকে আপনি ততোই বিরত থাকবেন 😉। ভালো না?
ম্যাকবুকের সিকিউরিটি অসাধারণ, এর নিজস্ব পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করার যে পদ্ধতি আছে, সেটা দিয়ে আপনি অ্যাপলের ব্রাউজার দিয়ে কোনও সাইটে লগইন করেন, আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েই লগইন করতে পারবেন। শুধু তাইই না, আপনি সাফারি ব্যবহার না করলেও ক্রম বা এজ সফটওয়্যার ব্যবহার করলেও একটা অ্যাড-অন এর মাধ্যমে আপনার সমস্ত ওয়েবসাইটের লগইন থাকবে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে সুরক্ষিত।
এ তো গেলো শুধু পাসওয়ার্ডের কথা, আপনার ফাইলগুলো যেনো কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে চুরি না করতে পারে, এর জন্যেও অ্যাপলের সিকিউরিটি ফিচারগুলো অসাধারণ, এর জন্য অতিরিক্ত কোন অ্যান্টি-ভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করারও প্রয়োজন নেই যদি আপনি আমার তথ্য ব্যবহার করার বিষয়ে সতর্ক থাকেন। গত তিন বছর ধরে আমি সিকিউরিটি ব্যবস্থাপনার জন্য এই ডিভাইসে কিছুই ব্যবহার করিনি।
অ্যাপলের যে ব্যাটারি পারফরম্যান্স, অসাধারণ। এম১ প্রসেসর ARM প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে অন্যান্য অনেক সাধারণ উইন্ডোজ ল্যাপটপের তুলনায় দ্বিগুণ সময় পর্যন্ত ব্যাটারি ব্যাকআপ থাকে। দৈনন্দিন নিয়মিত কাজ এর পাশাপাশি আপনি যদি কোন ভারী কাজ না করেন, অনায়াসে আপনি ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যাটারি ব্যাকআপ পাবেন।
ARM প্রযুক্তির প্রসেসর সমস্ত অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোনে ব্যবহৃত হয়, তাই বুঝতেই পারছেন ম্যাকবুকের ব্যাটারি কতো ভালো।
এছাড়াও এই ল্যাপটপের ক্যামেরা 1080p রেজোল্যুশনের ভিডিও রেকর্ড করতে সক্ষম। অফিসের ভার্চুয়াল মিটিংগুলোতে বেশিরভাগ মানুষকে সাধারণতঃ 480p তে দেখতে পাবেন, কিছু ভালো ল্যাপটপে হয়তো 720p রেজোল্যুশন পাবেন, কিন্তু আপনি যদি ম্যাকবুকে মিটিং করেন, আপনাকে সবাই দেখতে পারবে একেবারে ঝঁকঝঁকা ফুল-এইচডি তে। দারুন না?
এই ক্যামেরা দিয়ে চাইলে ভ্লগিং বা নিজের ভিডিও রেকর্ডিং এর কাজ সেরে নিতে পারবেন, আলাদা করে মোবাইলের প্রয়োজন হবে না। তারপরেও যদি আপনার আইফোন বা আইপ্যাড থাকে, অ্যাপলের কন্টিনিউয়িটি নামে একটা ফিচার আছে যেটার মাধ্যমে আপনি আপনার ফোন বা প্যাডের ক্যামেরা ব্যবহার করেও ল্যাপটপে ভিডিও কলিং এবং রেকর্ডিং এর কাজ করতে পারবেন।
আর জানেনই তো আইফোনের ক্যামেরার মান কেমন, এখন তো এটা দিয়ে প্রফেশনাল গ্রেডের সিনেমাও নির্মান হচ্ছে।
আর অ্যাপলের ইকোসিস্টেমের কথা আর কি বলবো, আপনি চাইলেই আপনার ফোনের কল এবং মেসেজ ল্যাপটপ থেকেই সারতে পারবেন, যদি আপনার আইফোন থাকে। আমার আইফোন নেই যদিও, তবে আমার বর্তমান ফোন নষ্ট হলে এরপরে আমি শুধু এই ফিচারের জন্যেই আইফোন কিনবো। আগেই বলেছি আমি আসলে ফোন তেমন পছন্দ করি না। ল্যাপটপ থেকে সব করতে পারলে ফোন শুধু চার্জ থাকলেই হলো, বাইরে যাওয়া ছাড়া আমার কাজে লাগবে না।
খুবই ভালো, কিন্তু ম্যাকবুকে তো গেম খেলা যায় না
এটা আগে হয়তো ছিলো, আমি নিজে Epic Games এবং Steam দু’টোই ইন্সটল করেছি এবং দুইটা গেম স্টোরেই আমার বিভিন্ন গেম কেনা আছে। হতে পারে আপনি পাইরেটেড গেমস ইন্সটল করতে চান, সেক্ষেত্রে হয়তো এটা করা প্রায়ই অসম্ভব, কিন্তু আধুনিক সব ধরণের গেম অ্যাপলের জন্যেও ডিজাইন করা হয়।
এছাড়াও অ্যাপলের নিজস্ব Arcade গেম স্টোর আছে, সেখান থেকেও আপনি Tomb Raider, Final Fantasy এর মতো নাম করা টাইটেলগুলোও ইন্সটল করে খেলতে পারবেন।
সবশেষে
মনে হতে পারে অ্যাপল প্রোডাক্টে হাতি কেনার থেকে পোষার খরচ বেশি। কিন্তু একজন প্রফেশনাল কখনই চাইবে না তার ডিভাইস নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকুক। এছাড়াও অ্যাপলের সফটওয়্যারের স্মুথনেস বলেন, পারফরমেন্স বলেন সবকিছু অ্যাপল থেকে তাদের নিজস্ব অ্যাপ স্টোরের মাধ্যমে কোয়ালিটি চেক করে অনুমতি দেওয়া হয়, তাই নিঃসন্দেহে এটা একজন প্রোডাকটিভ মানুষের জন্য কাজের ডিভাইসই হবে।
আর আমার মতো গেম, ভিডিও, অডিও, গ্রাফিক্স ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে চাইলে একেবারে সর্বোচ্চ ল্যাপটপ অভিজ্ঞতা পাবেন অ্যাপল ম্যাকবুক থেকে। শুরুতেই বলেছিলাম আমার ডেস্কটপ পছন্দ, কিন্তু এই ল্যাপটপ ব্যবহার করে আমি ডেস্কটপ লেভেলের থেকেও ভালো পারফরম্যান্স পেয়েছি। তাই আমার মতো মানুষদের জন্য এই ল্যাপটপ আসলেই বাজেট ল্যাপটপ।